ফারজানা ফারাবী, ধর্মীয় ডেক্সঃ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। এতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। একজন মুসলিম কেবল নিজের ইবাদত ও আখিরাতের চিন্তায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার জীবনের প্রতিটি দিক ইসলামের আলোকে পরিচালিত হওয়া জরুরি। আল্লাহ তাআলা কুরআনে ঘোষণা করেছেন—“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা মায়িদাহ: ৩)। অর্থাৎ ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যা মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ হলো নামাজ। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—“ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের উপর দাঁড়ানো: শাহাদাত, নামাজ কায়েম, যাকাত প্রদান, রমজান মাসে রোজা রাখা এবং হজ।” (বুখারি, মুসলিম)। নামাজ কেবল একটি আনুষ্ঠানিক ইবাদত নয়, বরং এটি আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে, চরিত্রকে গঠন করে এবং সমাজকে মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন—“নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।” (সূরা আনকাবুত: ৪৫)। তাই নামাজ কায়েম করা মানে শুধু নিজে নামাজ আদায় করা নয়, বরং পরিবারকে নামাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা এবং সমাজে নামাজ প্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টি করা। এজন্যই আল্লাহ তাআলা বলেছেন—“তুমি তোমার পরিবারকে নামাজের আদেশ দাও এবং নিজেও তা ধৈর্যসহকারে পালন করো।” (সূরা ত্বাহা: ১৩২)।
একজন মুসলিমের প্রথম দায়িত্ব হলো তার নিজের ইমান ও আমল রক্ষা করা। নিয়মিত ইবাদতে মনোযোগী হওয়া, আল্লাহর ভয় অন্তরে ধারণ করা এবং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা অপরিহার্য। কুরআনে বলা হয়েছে—“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য মুক্তির পথ সৃষ্টি করবেন।” (সূরা ত্বালাক: ২)। একই সঙ্গে তার চরিত্রে সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও সুন্দর আখলাক ফুটে উঠতে হবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—“মুমিনদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যার আখলাক সর্বোত্তম।” (তিরমিজি)।
পরিবারের প্রতি দায়িত্ব একজন মুসলিমের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরিবার সমাজের ভিত্তি, আর ইসলামী শিক্ষায় পরিবারকে কেন্দ্র করেই নৈতিক সমাজ গড়ে ওঠে। একজন মুসলিমকে অবশ্যই পরিবারে ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সন্তানদের কুরআন-হাদিস শেখাতে হবে, স্ত্রী-সন্তানকে ভালোবাসতে হবে এবং হালাল উপার্জনের মাধ্যমে পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—“তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (বুখারি, মুসলিম)। পরিবারের মধ্যে যদি ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে গোটা সমাজ আলোকিত হবে।
প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—“যে আল্লাহ ও পরকাল দিবসে বিশ্বাস করে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।” (বুখারি, মুসলিম)। কুরআনেও আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন—“আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না, আর পিতা-মাতার সাথে সৎ আচরণ করো; আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন, নিকট প্রতিবেশী ও দূর প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করো।” (সূরা নিসা: ৩৬)। এর মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায় যে প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার ঈমানেরই একটি অংশ।
সমাজের প্রতি দায়িত্বও একজন মুসলিমের কর্তব্য। একজন মুসলিমকে সবসময় সততা ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখতে হবে, গরিব-অসহায়দের সাহায্য করতে হবে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। রাসূল ﷺ বলেছেন—“তোমরা যারা অন্যায়ের সাক্ষী থাকবে অথচ তা পরিবর্তন করবে না, তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (তিরমিজি)। অর্থাৎ সমাজে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া বা অবিচার মেনে নেওয়া ইসলামের শিক্ষা নয়। সমাজের উন্নয়ন, শিক্ষা ও নৈতিকতা বিস্তারে মুসলিমদের ভূমিকা রাখতে হবে।
একজন মুসলিমের দেশের প্রতি দায়িত্বও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইন মেনে চলা, জাতীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং দেশের উন্নয়নে কাজ করা ইসলামের আলোকে কর্তব্য। রাসূল ﷺ বলেছেন—“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে মানুষের জন্য সর্বাধিক উপকারী।” (দারাকুতনি)। অতএব, দেশের কল্যাণে কাজ করা, মানুষকে উপকার করা এবং জাতির উন্নয়নে অংশ নেওয়া প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব।
আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের প্রতি দায়িত্বও ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলাম আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। রাসূল ﷺ বলেছেন—“যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (বুখারি, মুসলিম)। আবার বন্ধুবান্ধবকে সৎকাজে উৎসাহিত করা, বিপদে পাশে দাঁড়ানো এবং একে অপরকে কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করাও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। নামাজ কায়েম করা যেমন একজন মুসলিমের অপরিহার্য দায়িত্ব, তেমনি পরিবারের যত্ন নেওয়া, প্রতিবেশীর হক আদায় করা, সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখা এবং দেশের কল্যাণে কাজ করাও সমানভাবে জরুরি। একজন প্রকৃত মুসলিম তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা অনুসরণ করবে। এভাবেই দুনিয়া শান্তিপূর্ণ হবে এবং আখিরাত হবে মুক্তির স্থান।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নামাজ কায়েম করার তাওফিক দিন, পরিবার-সমাজ-জাতির প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার শক্তি দিন এবং ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জীবনে ফুটিয়ে তোলার সুযোগ দিন, আমিন।